13/07/2021
কর্জে হাসানা কী ও কেন?
যিনি নামাজ পড়েন, জাকাত দেন, কর্জে হাসানা দেন এবং আল্লাহ পাকের কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান- তাহলে তাকে আল্লাজ কর্জে হাসানার সওয়াব বহুগণে দেবেন, সম্মানজনক পুরুস্কার দিবেন এবং ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত।
‘করজ’ অর্থ ঋণ, ধার বা কর্জ; আর হাসানা অর্থ উত্তম। উভয়ে মিলে ‘উত্তম ঋণ’। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায়, সওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে কাউকে কোনো কিছু ঋণ দিলে তাকে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলে। ইসলামী আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় কর্জে হাসানার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পবিত্র কোরআনুল কারিমের সূরা আল হাদিদের ১৮তম আয়াতে মহান রাববুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় দানশীল নর-নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদের দেয়া হবে বহুগুণ। তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ তবে এজন্য শর্ত হচ্ছে, প্রদানকৃত বস্ত্তটি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ঋণদাতা খাতককে তাগাদা না দেয়া। যেমনটি সূরা বাকারার ২৮০তম আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘যদি খাতক অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তার সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম। যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ কর্জে হাসানার মাধ্যমে আমাদের সমাজে চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো বদল না দেখা গেলেও এর নেপথ্যে রয়েছে সামাজিক দৈন্য, পারিবারিক কলহসহ নানা অসংতি দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; এর মাধ্যমে আমাদের পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, দারিদ্র্যবিমোচন ও ধনী-গরিবের বিভেদ উপেক্ষত হওয়ার ব্যাপারটি নিতান্তই সম্ভাব্য ও সহজসাধ্য। সুদখোরদের অভ্যাস হচ্ছে, খাতক নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম না হলে সুদের অঙ্ক আসলের সঙ্গে যোগ করে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের কারবার চালানো। উপরন্তু সুদের হারও আগের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়া; যেমনটি সূরা আলে ইমরানের ১৩০তম আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সুদ খেও না দ্বিগুণ চতুর্গুণ এবং আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায়, তোমরা সফল হবে।’ কিন্তু কর্জে হাসানা পুরো এর বিপরীতার্থক। এতে একদিকে যেমন খাতকের উপকার হয়, তেমনি সুদ থেকেও বাঁচা যায়। এ কারণেই হাদিস শরিফেও কর্জে হাসানা প্রদানে বান্দাকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে কর্জে হাসানা ১. সদকা বিষয়ে পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সদকা বা দান ইসলামে সৎকর্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর চেয়েও উত্তম হচ্ছে কর্জে হাসানা। যে কারণে জগতের কোনো কিছুর যিনি মুখাপেক্ষী নন, যিনি সব বস্ত্তমোহ নিরপেক্ষ সেই সর্বশক্তিমান মহিমান্বিত আল্লাহ তার বান্দার জন্য আমাদের কাছে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ চেয়েছেন। বলেছেন, ‘কে সে, যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা (যে বিনিয়োগ স্বার্থভাবে দেয়া হয়) প্রদান করবে? তিনি তাহার জন্য ইহা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন।’ [সূরা বাকারা, আয়াত-২৪৫।] ২. ‘আর আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি; তোমরা যদি সালাত কায়েম কর, জাকাত দাও, আমার রসূলদের ওপর ঈমান আন ও সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করব এবং নিশ্চয়ই তোমাদের দাখিল করব জান্নাতে, যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এর পরও কেউ কুফরি করলে সে তার সরল পথ হারাবে। [সূরা-মায়িদা, আয়াত-১২।] ৩. ‘কে আছে, যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ, তাহলে তিনি বহুগুণে ইহাকে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য আছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ [সূরা-হাদিদ, আয়াত-১১।] ৪. ‘দানশীল পুরুষ এবং দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে, তাদের দেয়া হবে বহুগুণে বেশি এবং তাদের জন্য আছে সম্মানজনক পুরস্কার। [সূরা- হাদিদ, আয়াত -১৮।] ৫. ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী ও ধৈর্যশীল। [সূরা- তাগাবুন, আয়াত -১৭।] ৬. ‘অতএব সালাত কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ। তোমরা তোমাদের নিজেদের মঙ্গলের জন্য ভালো যা কিছু অগ্রিম প্রেরণ করবে; তা তোমরা পাবে আল্লাহর কাছে উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহোত্তম। আর তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর কাছে; নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [মুযযাম্মিল, আয়াত-২০।] ‘কর্জে হাসানা’ নামটি অতি সুন্দর এবং আমরা কমবেশি এ নামটির সঙ্গে পরিচিত। বর্ণিত আয়াতগুলোর মর্মার্থ হলো-যিনি নামাজ পড়েন, জাকাত দেন, কর্জে হাসানা দেন এবং আল্লাহ পাকের কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান- তাহলে তাকে আল্লাজ কর্জে হাসানার সওয়াব বহুগণে দেবেন, সম্মানজনক পুরুস্কার দিবেন এবং ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত। কর্জ প্রসঙ্গে হাদিসে আরও বর্ণিত কোরআন পাকে কর্জে হাসানা প্রদান করলে বহুগুণ সওয়াবের কথা উলেস্নখ আছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) ফরমায়েছেন, আমি যখন মেরাজে গিয়েছিলাম, তখন বেহেশতের দরজার ওপর লেখা দেখেছি, খয়রাতের সওয়াব ১০ গুণ, আর কর্জে হাসানার সওয়াব ১৮ গুণ। দান বা খয়রাত ফেরত দিতে হয় না কিন্তু কর্জে হাসানা ফেরত দিতে হয়। কর্জে হাসানা ফেরত দেয়ার পরেও প্রায় দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়ার কারণ আছে। মূলত পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক প্রতিটি মানুষকে স্বাবলম্বী করার জন্য ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে মুসলমানরা, তালির ওপর তালিযুদ্ধ ছিন্নবস্ত্র পরিধান করা, ঋণ গ্রহণ অপেক্ষা উত্তম। যদি তা শোধ করার শক্তি না থাকে। (মুসনাদ আহমাদ) রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে মুসলমানরা ঋণ গ্রহণ থেকে বেঁচে থাক। কেননা, ঋণ রাত্রীকালে মর্ম বেদনা ও দুঃশ্চিন্তা সৃষ্টি করে এবং দিনের বেলায় অপমান ও লাঞ্চনায় লিপ্ত করে। (বায়হাকি) অনেকে আছেন ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিয়ে বেমালুম হজম করেন। তাদের পরিচয় ঋণখেলাপি। অথচ অনেকে শখের বশে ব্যবসায়ের খাতে ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তাদের জন্য রাসূল (সা.) এর সতর্কবাণী। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) এর একটি দীর্ঘ হাদিস রাসূলুল্লাহ (সা.) ঋণ সম্পর্কে বলেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, যদি কোনো ব্যক্তি জিহাদে শহীদ হয়ে যায়, জীবিত হয়ে (পুনরায়) শহীদ হয়ে যায় আবার জীবিত হয়ে (তৃতীয়বার) শহীদ হয়ে যায়, তার জিম্মায় কারও ঋণ প্রাপ্য থাকলে সে জান্নাতে যাবে না, যে পর্যন্ত তার ঋণ শোধ করা না হয়। (নাসায়ি, তিবরানি, হাকেম) তবে রাসূলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করে এবং তা পরিশোধ করার ইচ্ছা রাখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার পক্ষ থেকে তার ঋণ শোধ করে দেবেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঋণ শোধ করার ইচ্ছা রাখে না এবং এ অবস্থায় মারা যায়, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি বোধ হয় মনে করেছিলে, আমি আমার বান্দার হক তোমার কাছ থেকে আদায় করব না। এরপর ঋণ গ্রহীতার কিছু সৎকর্ম ঋণ দাতাকে দেয়া হবে। সে যদি কোনো সৎকর্ম না করে থাকে, তবে ঋণদাতার কিছু গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। (তিবরানি, হাকেম)। দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য নিজের কাছে অর্থ না থাকলে কর্জ করতে হয়। তাই কর্জে হাসানা চালু করা জরুরি। বিভিন্ন মেয়াদে কর্জে হসানা চালু করতে পারলে এবং তা সার্কুলেশনে ছেড়ে দিলে অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধি পাবে। যেসব মানুষ জাকাত/ সদকা খেতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে, তাদের এবং অন্য ধর্মের দরিদ্র মানুষকে স্বাবচলম্বী করার লক্ষ্য কর্জে হাসানা চালু করা উচিত। কর্জের ব্যাপারে কোরআন এবং হাদিসে যা বর্ণনা আছে, তা কর্জে হাসানা নেয়ার সময় অবহিত করা প্রয়োজন। তাহলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।
মুহাম্মদ বাছির উদ্দিন
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
সৌজন্যে : দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ